অভিজিৎ রায় এবং পারভেজ আলম,এই দুইজনের প্রায় সব লেখাই পড়েছি এবং পড়ি,পারত পক্ষে কখনোই মিস করিনা।
অভিজিৎ দা যখন জঙ্গী উন্মাদনাকে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ হিসেবে দেখে ধর্মকেই এর জন্য দোষি সাব্যস্ত করেন তখন মেনে নিতে পারি না। আবার পারভেজ আলম যখন জঙ্গীদের ‘সালাফি ইসলাম’ হিসেবে চিহ্নিত করতে চায় তখনও মেনে নিতে পারিনা। সেই ভিত্তিতে আমার নিজস্ব একটা মত আছে। আর প্রকাশ না করতে পারলে মতামতের দুর্বলতাও তো ধরা পড়বে না।
মানুষ নানা লক্ষ্যে একত্র হতে পারে। প্রাথমিক দিকে রাষ্ট্র গুলো ধর্মের নাম না হয় রাজার নামে সৈনিকরা যুদ্ধ করতো। গ্রীকরা প্রথম জাতীয়তা বোঝ নিয়ে দেশের জন্য লড়াইয়ে নামে। আমরা একাত্তুরে বাঙ্গালী জাতীয়তা বোধ থেকে একত্র হয়ে পাকিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি।
জেরুজালের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস দেখলে আরব জাতীর উপর এক ধরনের ধারান জন্মে। হত্যা,খুন,লুটতরাজ এসব আরব জাতীর খুব সাধারন কালচার। এবং আরবের এই কালচার ধর্ম ভিত্তিক না,জাতী ভিত্তিক বলেই মনে হয়। ঐ অঞ্চলের প্রায় সব ধর্মের মানুষই কিন্তু বর্বরাতায় সমান।গাজার উপর ইজরাইলের আক্রমন,তাদের শিশুদের হত্যা সহ নানা অপকর্ম তো আছেই।(এখানে শুদ্ধ জাতি বলে কিছু বোঝাতে চাইছি না। এথেনিয়,রোমানরা যতই আক্রমন করোক,তাদের সাথে মিশে যাক কিন্তু আদতে আরবরা একত্রই ছিল।) অন্তত সমস্ত আরবের একটা কালচার আছে।
সভ্যতা কখনো সার্বজনীন হয়না। প্রতিটা জাতী,সময়,ভৌগলিক অবস্থানের জন্য আলাদা আলাদা হয়।গ্রীক সভ্যতার স্বর্ণযুগে পেরিক্লিসের শাসন আমল মানুষের সাঙস্কৃতিক মান অনেক উন্নত ছিল। ধারনা করা হয় শিল্প,সাহিত্য,সংস্কৃতির দিক দিয়ে পেরেক্লিসের আমল এতটাই উন্নত ছিল যা এই সময়ও অার আর্জন করা যায় নাই। কিন্তু সেই সময়টা ছিল দাশ প্রথার যুগ। দাস প্রথা সেই সময়ে অন্যায়,নিষ্ঠুর হিসেব ধরা হতো না।
প্রতিটা জাতীর সভ্যতার মাপকাঠি আপেক্ষিক। ইসলাম আসার আগে আরবরা কি সভ্য ছিল? ইতিহাস তা বলে না। সমস্ত পৃথিবী যেভাবে এগিয়ে গেছে আরবরা সেভাবে পারে নাই। জাতী হিসেবে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান,শিল্প-সাহিত্যে অনেক পিছিয়ে আছে। জাতী হিসেবে তাদের পরিবর্তন কয়েক হাজার বছর আগে যা ছিল এখনো তার কাছাকাছিই আছে। শিরচ্ছেদ বিষয়টা আমাদের কাছে খুব বর্বর মনে হলেও আরবের মানুষের কাছে এটা সাধারণ ঘটনা,কারন তারা এটাতেই অভ্যস্ত। তাদের আবহাওয়া,জলবায়ু,মরুভুমি ইত্যাদি বিবেচনায় আনলে খুব সহজেই বুঝা যায় আমাদের সবুজ দেশের মানুষের মতো আবেগপ্রবন তারা নয়,আবার ইউরোপের মতো ঠান্ডামেজাজের গম্ভিরও না। তারা তাদের মতো ঐতিহাসিক ভাবে রুক্ষ। গোষ্টি প্রধান সমাজ ব্যবস্থা এখনো টিকিয়ে রেখেছে।
আমি কতটা সভ্য এটা যাচাই করা হবে নিশ্চয় আমার দেশের প্রেক্ষাপট অনুসারে। ইউরোপের একজন লোকের সাথে নিশ্চয় তুলনা হবে না। আমার দেশে যেখানে সেখানে চিপসের প্যাকেট ফেলতে পারি,থুথু ফেলতে পারি। কেবল এমন কয়েকটা বিষয় ইউরোপে হয়তো অসভ্যতা,কিন্তু আমরা অহরহ করি বলে এসব তেমন ঘৃনার দৃষ্টিতে দেখি না। আরবদেরও দেখতে হবে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে। ইউরোপের সাথে তুলনা করে নয়।
ভারতবর্ষ যখন সমৃদ্ধ ছিল ইউরোপের মানুষের কাছে তা ছিল লোভনীয়। কলম্বাস কেন ইন্ডিয়া আবিশ্বাকারের অভিযান চালিয়েছিল? ইংরেজরা এত পথ পাড়ি দিয়ে কেন ভারতবর্ষে এসেছিল? এই ভারতবর্ষ দখলে রাখার জন্য কত রকম নিকৃষ্টি পদ্ধতির আশ্রয় তারা নিয়েছে,জাতীতে ভাগ করে, ধর্মীয় দাঙ্গা উস্কে দিয়েছে। জাতিভেত,ধর্ম ভেদ এই অঞ্চলে বরাবরই ছিল কিন্তু বহুকাল যাবত তো মানুষ শান্তিতেই বসবাস করে আসছিল হঠাৎ কেন দুই দলে ভাগ তিন টুকরা হয়ে গেল? তখনই চলে আসে অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয় ভারতবর্ষ ভাগ না হলে মুসলমানরা থাকতো পিছনে পড়ে, মুসলমান ব্যবসায়ী,ধনিক শ্রেনি হিন্দুদের সাথে প্রতিযোগীতায় পারছিলনা। তাই দেশ ভাগ করে নেয়াটা ছিল তাদের জন্য লাভজনক। আর সেই ধনিক শ্রেনির রাষ্ট্র ব্যবস্থা তা করতে দিয়েছে। হিন্দু মুসলমান ভাগ হয়ে যতটা ধর্মীয় লাভবান হয়েছে তার চেয়ে হয়েছে বেশি অর্থনৈতিক। তার মানে ধর্মের নামে বিবাজনের পিছনে উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক।
পাকিস্তানি ইস্পাহানির প্রধান চেয়েছিলেন শেখমুজিবকে ক্ষমতা দিয়ে পূর্বপাকিস্তানকে স্বায়িত্বশাসন দিয়ে দেয়া। কারন সে ব্যবসায়ী,রাজনৈতিক ঝামেলার কারনে তার ব্যবসা খারাপ যাচ্ছিল। আর দুই ভাগ হয়ে গেলে তার ব্যবসার বাজার কমে যাবে।অতএব ইসপাহানির সমর্থন আর বঙ্গবন্ধুর সমর্থন এক হলেও উদ্দেশ্য কিন্তু ভিন্নই ছিল।
আরব তেল সমৃদ্ধ দেশ হওয়ায়,সারা বিশ্বের কাছে একটা লোভনীয় স্থান। তাদের তেল লুট করার জন্য বিশ্বমোড়লরা মুখিয়ে আছে। ইরাক আক্রমন করা হয়েছে কোন যুক্তিতে? কিন্তু দেখা গেল খামখেয়ালীর মতো একটা যুক্তি দিয়ে একটা রাষ্ট্রকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে? আইএস বিষয়টাও আমার কাছে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বলেই মনে হয়। ১৯৭৩ সালে কিউবার সাথে পাট রপ্তানির খেসারত দিতে হয়েছিল বাংলাদেশকে দুর্ভিক্ষ দিয়ে। আম্রিকার নির্দেশ ছাড়া কিউবাতে একটি পাখিও যেতে পারে না। আরবের রাষ্ট্র গুলো আইএস এর বিরোধিতা করলেও তারা কি করে এই অস্ত্র,অর্থের যোগান পায়? কে দেয় তাদের অস্ত্র? এখনো পর্ন্ত সিআইএ কি এই তথ্য বের করতে পারে না?
আম্রিকা যেই সব দেশে হস্তক্ষেপ করেছে,সেখানেই জন্ম নিয়েছে একটি জঙ্গী সংগঠন। সিরিয়া,ইরাক তো আইএস,তুরস্ক,মিশর,লিবিয়া সব খানে স্যাকুলার থেকে আরো জঙ্গিপনার দিকেই ঝুকছে। কিন্তু কেন? আম্রিকা যদি মুক্ত করতেই যায় সেখানে স্যাকুলারিটির পতন ঘটে আর জঙ্গী উত্থান ঘটে কি করে?
আমার মতামত,সরা বিশ্বে ইসলামী জঙ্গীদের যে উন্মাদনা রয়েছে তার পেছনে হাত রয়েছে আম্রিকার। এবং আম্রিকার উদ্দেশ্য সফল করতে তারা ধর্মীয় জঙ্গীদের আশ্রয় নিয়েছে। ৭১ সালে স্যাকুলার বাংলাদেশের দিকে নয় ধর্মীয় পাকিদের পক্ষেই তারা সমর্থন দিয়েছিল।
তবে কথা থাকে অন্য অঞ্চলে জঙ্গীরা কেন সক্রিয়! সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন সমাজতন্ত্রের ভিত্তি হয়,তখন অন্যান্য অঞ্চলেও তার প্রভাব পড়ে,অনেক ছোটখাট সমাজতান্ত্রিক মোভমেন্ট সারা বিশ্বেই দেখা যায়। সোভিয়েত পতনের পর আবার মিলিয়ে যায়। ইসলামী জঙ্গীদের বেলাতেও এটা এমন হতে পারে।
এডয়ার্ড সাইদ দেখিয়েছেন যে বিশ্বের যত সোসাই বোম্বিং হয়েছে তার বেশির ভাগই হয়েছে জাতীয়তাবাদী আদর্শ কেন্দ্র করে। ধর্মীয় আদর্শ কেন্দ্র করে হয়েছে সেই তুলনায় কম। যে কোন আদর্শ কেন্দ্র করেই চরমপন্থায় পোঁছানো যায় তখন এই ধরনের ঘটনা স্বাভাবিক,জাপানি বোমারো বিমান এমন ভাবেই আক্রমন করেছিল, বাংলাদেশের অনেক মুক্তিযুদ্ধাদের এমন সাহসি কথাও আছে। শ্রিলংকার তামিল গেরিলারা অনেক সোসাইড বোম্বিং করেছে। প্রতিটা সেনাবাহিনীর সদস্যরা যখন যুদ্ধে যায় তখন মৃত্যু হতে পারে জেনেই যায়। এটাও এক ধরনের সোসাইড। কিন্তু কেন যায়,সেনাবাহিনির সদস্যরা কি পরকালের লোভে যায়? যে কোন বাহিনীর সদস্যদের এমন ভাবে উদ্বোধ্য করা হয় যখন মৃত্যুর তার কাছে কোন ব্যপারই মনে হয়না। আমি বলতে চাইছি ধর্মকে ব্যবহার না করেও এমন করা সম্ভব। সেই ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে,তার জাতীয়তা,দেশ প্রেম ইত্যাদি। আর ইসলামী জঙ্গীরা তাদের উজ্জেবিত করার জন্য ব্যবহার করছে কোরান,পরকাল ইত্যাদি।এই উজ্জেবিত করাটা যদি ভাইরাস আক্রান্ত হয় তাহলে পৃথিবীর সব সেনাবাহীনি ভাইরাস আক্রান্ত। আর এই সেনাবাহীনির পৃষ্ঠপোষক দেশ ও ভাইরাস আক্রান্ত? আমার তা মনে হয়না।
আর শুদ্ধ ইসলাম বলতে কোন চিজ নাই। যদি সালাফি ইসলামকে জঙ্গিপনার জন্য দায়ি করা হলে। শিয়া,সুন্নি,কাদিয়ানী,ওয়াহাবি ইত্যাদি নিজেদের মধ্য তো প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেই যাচ্ছে। তার যুক্তি কি থাকবে? সালাফিরা জঙ্গিপনা করছে কিন্তু অন্য দু একজন হয়তো মিউমিউ করছে এটা সত্য। কিন্তু এটাও সত্য যে খ্রিষ্টানদের আক্রমন করলে,হত্যা করলে অধিকাংশ মুসলিমরাই মনে মনে খুশি হয়? আম্রিকায় কুরান পুড়ালে,অথবা মোহাম্মদকে নিয়ে সিনেমা বানালে যেভাবে সারা বিশ্বে মুসলিমরা আন্দোলন করে। কিন্তু আইএস এর কার্যক্রম যদি ইসলাম বিরোধি হতো তবে তো একই রকম আন্দোলন দেখতে পেতাম। আমরা কিন্তু এমন কিছু দেখি নাই।
http://istishon.com/node/9659